নিজস্ব প্রতিবেদক
সমগ্র বিশ্বব্যবস্থা আজ ঝঞ্চা-বিক্ষুব্ধ। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা-বিপর্যয় এক চূড়ান্ত বাস্তবতা। মানববসভ্যতা আজ এমনই এক বিপর্যয়ের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে যেখানে প্রাচুর্য, সাফল্য, জৌলুস, অর্থ সবই আছে তবু আত্মবিশৃঙ্খলা, মনোযোগহীনতা, অতৃপ্তি এমনই এক অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করেছে, দেশ-সমাজ-পরিবার আজ পিষ্ট। এর থেকে পরিত্রাণের এক চমৎকার উপায় হলো সুফি স্পিরিচুয়ালিটি চর্চা।
বৈশ্বিক বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয় উতরাতে দরকার ব্যক্তির চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধন, আত্মোন্নয়ন, ও আত্মশুদ্ধি প্রতিষ্ঠা। বাহ্যিক সমস্ত অরাজকতাকে মোকাবিলা করতে দরকার পিসফুল মাইন্ড। তার জন্য দরকার আত্মা, অন্তর, মনন ও মানসিকতাকে বিকশিত করা বা তাসাউফ বা আত্মশুদ্ধি বা আধ্যাত্মিকতা অনুশীলন।
পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মই এই জায়গায় সমমত প্রদান করে যে, কেবলমাত্র বাহ্যিক সাফল্য কখনোই ব্যক্তির অভ্যন্তরকে তুষ্ট করতে পারে না। মানবমনকে শান্ত করতে, মনের ভিতরে শান্তি খুঁজে পেতে পৃথিবীর প্রায় সকল ধর্মই পরামর্শ মননশীলতা ও প্রেম চর্চার পরামর্শ দেয়। ইসলাম ধর্ম তথা কুরআন মননশীলতা তথা আধ্যাত্মিকতা চর্চাকে উৎসাহিত করে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম ধর্মের বিকাশ সে দিকটাই নির্দেশ করে— আরব-পারস্য-আফগান অঞ্চল থেকে আগত সুফি-দরবেশদের শান্তি ও সম্প্রীতির আহ্বানই এ অঞ্চলের হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মীয় মানুষদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে আর তার ফলাফলই আজ এই অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার।
ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়েও যথাযথ আধ্যাত্মিকতা চর্চার অনুপস্থিতি এবং বৈশ্বিক মানবিকতাহীনতার ছোঁয়া থেকে মুসলমানরা নিজেদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। এর বাইরে যুগের বিহঙ্গের আগ্রাসন- ব্যক্তি ও কর্মজীবনে দিশাহীনতা, উদ্দেশ্যহীনতা, শৃঙ্খলার বিপর্যয়ে জেরবার মুসলিম জাহান, বিশেষত তরুণদের মধ্যে উদাসীনতা, জীবনে আনন্দ খুঁজে না পাওয়া, মনোযোগহীনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো এমন ব্যাপক আকারে পৌঁছেছে যে, সেসব থেকে উত্তরণে নতুনভাবে সুফি স্পিরিচুয়ালিটি, চেতনা ও ভাবাদর্শ, প্রেম-ভক্তি-ভালোবাসা চর্চার আহ্বানে জন্মলাভ করে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
পবিত্র কুরআন-সুন্নাহ, আহলে বাইত (আ.), এবং জ্যোতির্ময় সুফিসাধকদের আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা অর্জন, আত্মশুদ্ধি এবং আত্মআবিষ্কারের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ ও তরুণদেরকে সুফিবাদ চর্চায় অনুপ্রাণিত করা, সমাজে ইসলাম ধর্মের মানবিকতা ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনুপ্রাণিত অসাম্প্রদায়িক সুষম সমাজ ও আলোকিত প্রজন্ম তৈরির লক্ষে বিগত এক যুগ ধরে সফলভাবে কাজ করে চলেছে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
ইসলাম ধর্মকে একটি আখ্যান হিসাবে বিবেচনা করলে আধ্যত্মিকতা হলো তার মূল আহ্বান। কিংবা এটিকে ফুল হিসাবে দেখলে আধ্যাত্মিকতা সেই সুগন্ধি ফুলের মোহনীয় সুবাস। ব্যক্তির অভ্যন্তর যখন আধ্যাত্মিকতার সুবাসে বেষ্টিত তখন সেই মননে ভেদাভেদ ও বৈষম্য ঠাঁই পায় না। সেই হৃদয় তখন জাগতিক সমস্ত বিচারের ঊর্ধ্বে উঠে সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়। সুফি স্পিরিচুয়ালিটি ইসলামের সেই মৌল নির্যাস ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যচর্চার কথা বলে।
ইসলামের প্রকৃত আহ্বান থেকে বিচ্যুত মুসলিম সমাজ আজ জ্ঞানহীনতা, বিচ্ছিন্নতা ও বিভ্রান্তির পথে পরিচালিত- এই উপলব্ধি আজ সর্বজ্ঞাত। বৈশ্বিকতা ও বস্তুবাদী শিক্ষা কেবলমাত্র বাহ্যিক ফলাফল আনয়ন করলেও হৃদয় অভ্যন্তরে বাসা বেঁধেছে বিশৃঙ্খলা, স্থবিরতা ও নৈরাজ্য। এই সংকট আজ বিশ্বব্যাপী। ইসলামি দর্শনের সঠিক প্রচার ও প্রসারে ইলমুত তাসাউফের অনপুস্থিতি লক্ষণীয়। এই অরাজকতা থেকে তরুণদেরকে টেনে বের করে আনতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
এক যুগের সুফি ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, চেতনা ও ভাবাদর্শ প্রচারের যাত্রায় ফাউন্ডেশন একটি বহুমুখী সেবা ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিকাশ লাভ করেছে যেটি ইতোমধ্যে দেশের ৭টি বিভাগের ২৫টি জেলায় কার্যক্রম বর্ধিত করেছে।
মানুষ কখনোই পূর্ণ সাফল্য ও তৃপ্তির দেখা পায় না; একইভাবে বর্তমান কোনো সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি দুঃখ, যন্ত্রণা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে ব্যর্থ হলেও কেউ সেই ব্যর্থতার সুলুক সন্ধানে আগ্রহী নয়। এই ব্যর্থতার কারণ নিহিত অস্তিত্বের গভীরে আর এখানেই সুফিবাদের অপরিহার্যতা।
মানুষের চাহিদা ও বাসনার সমন্বয়হীনতা, ভিতরে পুষে রাখা স্বার্থপরতা ও বিদ্বেষ, নিশ্চিত-অনিশ্চিতের বোধহীনতা মানবজাতির সামনে হাজির করেছে এক জাগতিক সংকট।
এত প্রাচুর্যের আড়ালেও নিঃসঙ্গতাকে মোকাবিলা করতে না পারার ব্যর্থতা থেকে পরিত্রাণে আগ্রহীদের জন্য সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন পরিচালনা করছে বিভিন্ন কর্মশালা, কোর্স ও সেমিনারের মতো নানা উদ্যোগ যেখানে শেখানো হচ্ছে কুরআনের গভীর মর্মার্থ, ইসলামি জ্ঞান ও সাহিত্য চর্চা ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগ-সুফি মেডিটেশন মেথড কোর্সে মননশীলতা, ধ্যান, শ্বাস-প্রশ্বাস ও একাগ্রতার মতো বহুবিধ কার্যকরী ও উপকারি বিষয়গুলো অনুশীলন করানো হচ্ছে।
ইসলামি সাহিত্য ও দর্শন, উলুমুল কুরআন ও উসুলে তাফসির, তাসাউফ, মাকাসিদ আশ শরীয়াহ, উসুলে সিরাত, ইসলামি চিন্তা ও দর্শনের ইতিহাস এবং ইসলাম ও বিশ্বসভ্যতা ইত্যাদি বিষয়ে পঠনপাঠন, অনুশীলন ও গবেষণার জন্য ফাউন্ডেশন থেকে ‘সুফি স্পিরিচুয়াল একাডেমি’ নামে একাডেমিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
নিয়মিত লেখালিখি ও পঠনপাঠনে প্রকাশিত হচ্ছে ‘সুফিনামা’ জার্নাল। এছাড়া, ‘কানিজ ফাতেমা হিফজুল কুরআন মডেল মাদরাসা‘, এবং ‘আলোকবর্তিকা পাঠাগার’ নামে আরও দুটি একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের জন্য ‘তাজরিয়ান শিশু সদন (এতিমখানা)’ এবং ‘বিররুল ওয়ালিদাইন’ নামক বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম পরিচালনা করছে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
আত্মকে সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদনই স্রষ্টাপ্রেমের প্রধান মাধ্যম-সেই অনুধাবন থেকে বিকশিত হওয়া প্রতিষ্ঠানটি ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রে প্রেম-ভালোবাসা-ভক্তি-নৈতিকতা-সাম্য প্রতিষ্ঠার বার্তা নিয়ে সৃষ্টির কল্যাণ ও অনগ্রসরের জীবনমান উন্নয়ন, জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে পুনর্জাগরণ, শান্তিপূর্ণ সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় সংযম, চিন্তা নবায়ন এবং যন্ত্রণা-বিদগ্ধ মানবমনে প্রেম ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
বিষয়ভিত্তিক সভা-সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার পাশাপাশি কুরআন-সুন্নাহ, সুফিতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা, পেশাজীবীদের সাথে মতবিনিময়, সংশ্লিষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তৈরি এবং তরুণ প্রজন্মের চিন্তাকে ইতিবাচক ধারায় বিকশিত করার লক্ষ্যে নিয়মিত মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সভা-সেমিনার-কর্মশালা ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বিষয়ে জানতে চাইলে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, তরুণ সুফি গবেষক ও লেখক জনাব খাজা ওসমান ফারুকী বলেন, “সমৃদ্ধ-আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ফাউন্ডেশনের যাত্রা। সুফি স্পিরিচুয়ালিটি সম্পর্কিত নানা মত ও দর্শন মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর ধর্ম ও বিশ্বাসের সাথে জড়িত বিধায় এটির সঠিক পঠনপাঠন ও চর্চা এগিয়ে নেওয়া, সঠিক ও প্রকৃত লিটারেচারের গবেষণা ও ডকুমেন্টেশন তো রয়েছেই-স্পিরিচুয়ালিটি ইসলামের সৌন্দর্য ও সুবাস, এই সুবাসকে বিকৃত চিন্তা ও তত্ত্ব থেকে মুক্ত করা; সুফি ভাবাদর্শ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও চেতনাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াস থেকেই সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশনের যাত্রা।
সাহিত্য, দর্শন, সংস্কৃতিতে সুফিসাধকদের অবদান ব্যাপক-জালালুদ্দিন রুমি, খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি, শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়ামসহ অসংখ্য সুফিসাধকগণ তাঁদের ভাষা ও শব্দের মোহনীয়তা, চিন্তা ও দর্শন দিয়ে সারা দুনিয়াকে মুগ্ধ করেছেন। স্থান-কাল-জাতির গণ্ডি পেরিয়ে তাঁরা সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যের কালজয়ী ধারা।
তারই ধারাবাহিকতায় আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার প্রসারে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে কাজ করে যাচ্ছে। সুফি চিন্তা ও গবেষণা, দৈনন্দিন জীবনে সুফি মেডিটেশন চর্চা, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে ভালোবাসা-ভক্তি-সহানুভূতি প্রচার-প্রতিষ্ঠায় ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। ধর্মীয় নীতি ও শিক্ষার প্রসারে জার্নাল, একাডেমিক প্রতিষ্ঠান, পাঠাগারের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি মানবিকতা ও মানবকল্যাণে বৃদ্ধাশ্রম ও এতিমাখানার কার্যক্রম পরিচালনা করছে সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম নিয়ে ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব প্রফেসর ড. ওসমান গণি বলেন, “বস্তুগত আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বাহ্যিক স্বীকৃতি ও দৃশ্যমান সাফল্য এনে দিতে পারলেও অভ্যন্তরের শূন্যতা জগতের সকল মানুষের মাঝে ক্রমবর্ধমান। মানসিক অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা থেকে মানুষের নিস্তার মিলছে না; এর সাথে দৈনন্দিন জীবনে মানসিক চাপ, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কোথাও মানুষ দুদণ্ড শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না।
সুফি স্পিরিচুয়ালিটি নির্দেশ করে শান্তি ও স্থিরতা কোনো জাগতিক বিষয় নয়; এটি অভ্যন্তরীণ বোধ। তাই দৈনন্দিন জীবনে প্রশান্তি আনয়নে সুফি মেডিটেশন, মননশীলতা, জিকির, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো বিষয়গুলো অনুশীলনের মাধ্যমে কীভাবে একাগ্রতা বৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে নিজেকে আবিষ্কারের মাধ্যমে জাগতিক আশা-আকাঙ্ক্ষার জাঁতাকল থেকে নিজেকে মুক্ত করে আত্মশুদ্ধি প্রতিষ্ঠা করা যায় ইত্যাদি বিষয়গুলো শিক্ষা দেয় সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।
ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের ধর্ম। বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মানবতার বিকাশে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিতে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে সুফি সেন্টার। সুফি ভাবাদর্শ উত্তেজনা সৃষ্টি নয়, অনুধাবনে বিশ্বাসী; কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী; ধ্বংসযজ্ঞে নয়, নির্মাণে বিশ্বাসী; কল্পনায় নয়, বাস্তবতায় বিশ্বাসী; ভোগবাদ ও প্রবৃত্তির অনুসরণে নয়, বরং ত্যাগ, কুরবানি ও পরোপকারে বিশ্বাসী সুফি দর্শন ও চিন্তাকে সর্বজনীন করে তুলতে, সমাজে ভালোবাসা-শান্তি ছড়িয়ে দিতে শ্রদ্ধা-বিশ্বাস ও সম্মানের সাথে সকলকে আহ্বান জানায়। প্রেম ও আলোর সাথে ভালোর প্রতিশ্রুতি দেয় সুফি স্পিরিচুয়াল ফাউন্ডেশন।